• বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৪ ১৪৩১

  • || ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

একজন রাখাল সাহাবির ঈমানদীপ্ত ঘটনা

প্রকাশিত: ১ ডিসেম্বর ২০১৮  

খায়বার যুদ্ধের ঘটনা। এই যুদ্ধে দু’জাহানের সরদার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিগণকে সঙ্গে নিয়ে ইহুদিদের সবচেয়ে বড় দুর্গ খায়বারের ওপর হামলা করেন।

খায়বারের ইহুদিদের পক্ষ থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্রের কথা শোনা যেতো। ফলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দুর্গ অবরোধ করেন, অবরোধ কয়েকদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

অবরোধ চলাকালে খায়বার শহরের একজন রাখাল, ইতিহাসে যিনি আসওয়াদ রাখাল নামে অভিহিত হয়েছেন, তিনি মনে মনে ভাবলেন, এত বড় বাহিনী নিয়ে, এত দূরত্ব অতিক্রম করে, এত কষ্ট সয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বার আক্রমন করেছে, গিয়ে একটু জেনে আসি তাঁর বুনিয়াদি দাওয়াত ও পয়গাম কী? সে কিসের দিকে মানুষকে আহ্বান করছে? তাঁর ইচ্ছা-ইবা কী?

রাখাল ঘর থেকে বের হয়ে মুসলিমবাহিনীর তাঁবুর দিকে অগ্রসর হলো। তাঁবুর কাছাকাছি একজন মুসলমানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হরো। তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি জানতে চাই তোমরা কেন খায়বারের ওপর চড়াও হয়েছে? কোন কারণে আমাদের শহরের বাসিন্দারা তোমাদের দুশমন হলো? তোমাদের মূল দাওয়াত ও পয়গাম কী?

 

মুসলমান লোকটি ছিলেন একজন সাহাবি । তিনি ইসলামের আকিদা ব্যাখ্যা করার পরিবর্তে আসওয়াদ রাখালকে বললেন, তুমি বরং আমাদের সরদার আল্লাহর রাসূল (সা.) সঙ্গে সাক্ষাত করে তাঁকেই এ প্রশ্নগুলো কর। তিনিই তোমাকে ইসলামের বুনিয়াদি দাওয়াত ও নেয়ামতের মূল পয়গাম সম্পর্কে বলে দিবেন।

আসওয়াদ রাখালের কাছে এই কথা একদম নতুন ছিল। তাঁর কল্পনায়ও ছিল না যে, কোনো বাহিনীর সিপাহসালার, কোনো ফৌজের বড় অফিসার কিংবা কোনো রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তার মত রাখালকে সশরীরে দরবারে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারে। সাক্ষাতকার দিয়ে তাকে ধন্য করতে। তিনি সারাজীবন এটাই দেখে এসেছেন যে, ধনাঢ্য, পদস্থ ও কর্তা ব্যক্তিরা তার মত রাখালদের সঙ্গে কথা বলতেও অসম্মান ও অপমানবোধ করে।

তাই তিনি বললেন, আমি তোমাদের সরদারের কাছে কীভাবে যাব? তিনি তো তোমাদের রাষ্ট্রের প্রধান। আর আমি সামান্য রাখালমাত্র। উত্তরে সেই সাহাবি বললেন, আমাদের সরদার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গরিবদের প্রতি অত্যন্ত সহমর্মী ও আন্তরিক। তাঁর মজলিসে ধনী ও গরিবের মাঝে, শাসক ও প্রজার মাঝে, নেতা ও কর্মীদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

রাখাল লোকটি খুবই অবাক হলো! নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সামনে অগ্রসর হলো। নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে ভয়ে ভয়ে দুরুদুরু মনে জিজ্ঞাসা করল, আমি আপনার কাছে জানতে চাই আপনার মূল দাওয়াত কী? আপনি কেন এই অঞ্চলে এসেছেন?

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে তাকে খুব সংক্ষেপে তাওহিদ সম্পর্কে বুঝালেন। আসওয়াদ রাখাল যখন তাওহিদ সম্পর্কে অবগত হলো, সে জিজ্ঞাসা করল, যদি কেউ এই বিশ্বাস গ্রহণ করে আপনার সঙ্গে শামিল হয়ে যায়, তা হলে তার কী লাভ হবে? তিনি বললেন, যদি তুমি এই বিশ্বাস গ্রহণ করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নাও তা হলে তুমি আমাদের ভাই হয়ে যাবে। তোমাকে আমরা আমাদের বুকে জড়িয়ে নিব। সকল মুসলমান যেসব অধিকার পায় তুমিও তা পাবে।

আসওয়াদ রাখাল অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কীভাবে সেসব অধিকার পাব অথচ আমি এক সামান্য রাখাল? আমার রঙ কালো। আমি কুৎসিত চেহারার অধিকারী। আমার দেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। আমার শরীরে ময়লা জমে থাকে। এই অবস্থায় আপনারা আমাকে কীভাবে বুকে জড়িয়ে নিবেন? কীভাবে আমাকে আপনাদের সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করবেন?

নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আশ্বস্ত করলেন। আসওয়াদ রাখাল বলল, যদি বিষয়টি এমনই হবে তা হলে আমি তাওহিদ ও একত্ববাদের ওপর ইমান আনব। আচ্ছা, আমাকে বলুন তো দেখি, আমার কৃষ্ণবর্ণ, কুৎসিত চেহারা, আমার দেহের ময়লা ও দুর্গন্ধের কী প্রতিকার হবে?

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, যদি তুমি তাওহিদের ওপর ইমান আন তা হলে দুনিয়ায় তোমার কুৎসিত চেহারা ও কৃষ্ণবর্ণের প্রতিকার না হলেও, যখন তুমি পরকালে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, তখন তোমার চেহারা শুভ্রোজ্জ্বল ও আলোকিত হবে। আল্লাহ তোমার চেহারার কালো রঙ নুর দ্বারা বদলে দিবেন। তোমার দেহের দুর্গন্ধ সুগন্ধির মাধ্যমে পরিবর্তন করে দিবেন। আসওয়াদ রাখাল বলল, যদি বিষয়টি তা-ই হবে তা হলে আমি ইসলাম কবুল করলাম, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াআশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ।

এরপর রাখাল লোকটি জিজ্ঞাসা করল, বলুন, এবার আমার দায়িত্ব কী? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলামে বহু ফরজ বিধান রয়েছে। তবে এখন নামাজের সময় না। রোজার মাসও না। তোমার ওপর জাকাতও ফরজ হয়নি। এখন হজের মওসুমও না। তাই তোমাকে নামাজ-রোজা, হজ-জাকাত কোনোটিই পালনের নির্দেশ দিতে পারি না। এখন তুমি একটি ইবাদতই করতে পার, তা হলো খায়বারের রণাঙ্গনে হক ও বাতিলের লড়াই চলছে, আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা তাদের প্রাণকে উৎসর্গ করছেন। এই মুহূর্তে তোমার দায়িত্ব হলো জিহাদে শামিল হয়ে যাওয়া।

আসওয়াদ রাখাল বলল, আমি যদি এই যুদ্ধে শহিদ হয়ে যাই তা হলে আমার প্রতিদান কী হবে? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাকে এ বিষয়ের জামানত দিচ্ছি যে, যদি তুমি এ জিহাদে শহিদ হয়ে যাও, তা হলে আল্লাহ তায়ালা তোমাকে সোজা জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে দিবেন। তোমার চেহারা উজ্জ্বল করে দিবেন। তোমার দেহের দুর্গন্ধ সুগন্ধি দিয়ে বদলে দিবেন।

তিনি যেই বকরিপাল সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোর ব্যাপারে বললেন, যেসব বকরি তুমি সঙ্গে নিয়ে এসেছ, এগুলো অন্যের। আগে এগুলো ফেরত দিয়ে এসো।

চিন্তা করে দেখুন, যুদ্ধের ময়দান, শত্রুবাহিনীর বকরির পাল। তিনি বকরিগুলো শত্রু এলাকার বাইরে নিয়ে এসেছেন। ইচ্ছা করলেই তিনি বকরির পালকে গনিমতের মালের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি যেহেতু এগুলোকে আমানত হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন আর আমানত প্রত্যাপণ করা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। তাই নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন, বকরিগুলোকে কেল্লার দিকে তাড়িয়ে দাও, যাতে এগুলো শহরের অভ্যন্তরে চলে যেতে পারে। মালিকের হাতে গিয়ে পৌঁছতে পারে। সেমতে তিনি বকরিগুলো শহরের দিকে তাড়িয়ে দিলেন। এরপর তিনি জিহাদে শামিল হয়ে গেলেন। দীর্ঘক্ষণ লড়াই চলল। যুদ্ধ শেষে খায়বার বিজয় হলো। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহিদদের লাশ দেখার জন্য বের হলেন। শহিদদের লাশের মাঝে আসওয়াদ রাখালের লাশটিও পড়ে ছিল। যখন লাশটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে আনা হলো, তাঁর মোবারক চোখ অশ্রুতে ভরে উঠল। তিনি বললেন, ইনি এক আশ্চর্য ব্যক্তি। এমন একব্যক্তি, যিনি আল্লাহর জন্য একটি সেজদাও করেননি। আল্লাহর রাস্তায় একটি পয়সাও খরচ করেননি। আল্লাহর জন্য অন্য কোনো ইবাদত করার সুযোগ তিনি পাননি। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি, ইনি সোজা জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে গিয়েছেন। আমি দেখছি, আল্লাহ তায়ালা তার চেহারার কৃষ্ণবর্ণকে নুর দ্বারা বদলে দিয়েছেন। তার দেহের দুর্গন্ধ ও ময়লা-আবর্জা সুগন্ধি দ্বারা সুরভিত করে দিয়েছেন।

এ হচ্ছে সাহাবিদের ঈমানের দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তায়ালা আমাদের মাঝে ঈমানের এমনই এক বন্ধন সৃষ্টি করে দিয়েছেন। প্রাচ্যের কি পাশ্চাত্যের যেকেউ মুখের ভাষা বুঝুক বা না-বুঝুক, তার সমাজ, কৃষ্টি, সভ্যতা ও জাতীয়তা যাই হোক, যখনোই জানা যায় যে, উনি মুসলমান, কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর আত্মীয়তায় আমাদের সঙ্গে শরিক, তখন তার জন্য হৃদয় থেকে আবেগ ও ভালোবাসা উৎসারিত হতে শুরু করে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন। সবচেয়ে মজবুত বন্ধন হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর বন্ধন। এই বন্ধন কখনোই ছিন্ন হওয়ার না। কখনোই ভেঙে যাওয়ার কিংবা দুর্বল হওয়ার নয়।

এই কালেমা আমাদের এক বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। এ এক আশ্চর্য কালেমা। এ এক আশ্চর্য দৃশ্যের অবতারণা করে। এ কালেমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে এতবড় বিপ্লব ঘটে যায় যে, এরচেয়ে বড় বিপ্লব হতেই পারে না। এই কালেমা পড়ার পূর্বে যে ব্যক্তি কাফের ছিল, কালেমা পড়ার পর সে মুসলমান হয়ে যায়। কালেমা পড়ার পূর্বে যে ব্যক্তি জাহান্নামের উপযুক্ত ছিল, আল্লাহর কাছে ঘৃণার পাত্র ছিল কালেমা পড়ার পর মুহূর্তেই সে জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে গেল। আল্লাহ তায়ালার প্রিয়পাত্র হয়ে গেল। হাদিস শরিফে এসেছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ قَالَ لَا اله إلا الله دخل الجنة

‘যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলল, সে জান্নাতি হয়ে গেল।’

জীবনে সে যদি গুনাহ করে থাকে, তা হলে গুনাহর শাস্তি ভোগ করার পর অবশেষে সে জান্নাত লাভ করবে। গুনাহ করল, ভুল-ত্রুটি করল কিন্তু তাওবা করল না, তা হলে তার শাস্তি হবে। কিন্তু শাস্তি ভোগ করার পর তার জন্য জান্নাত থাকবে। এটা আমার কথা না। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা।

কালেমা শরিফ পড়ার পর, একজন মানুষ জাহান্নামের সপ্তম স্তর থেকে বেরিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের ঈমানের সঙ্গে কবর জগতে যাওয়ার তাওফিক দান করুক।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –