• শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৪ ১৪৩১

  • || ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

গোরস্থানের ইতিহাস..

প্রকাশিত: ১০ নভেম্বর ২০১৮  

পাতাবিহীন মরা গাছ, জং ধরা পুরানো লোহার বড় গেট, ক্ষয় হয়ে যাওয়া স্মৃতিফলক, একজন স্বজনহারানো মানুষকে হয়তো দেখা যাচ্ছে প্রিয়জনের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শোক করতে। কবরখানা বা গোরস্থানের নাম শুনলে মনে এরকম ভয়াতুর ছবি ভেসে উঠতে বাধ্য। কিন্তু খুব বেশি দিন আগে নয়, গোরস্থান ছিলো একটি প্রাণ-প্রাচুর্যপূর্ণ এলাকা। ভারতবর্ষের কথা বলতে পারছি না, পাশ্চাত্যে তো ছিলোই। ফুলে ফুলে সুসজ্জিত বাগান, রকমারি মানুষের ভীড়, উৎসব- এসব ছিলো গোরস্থানের সাধারণ দৃশ্য। সেই ঝলমলে গোরস্থান কীভাবে আজকের এই প্রাণশূণ্য অবস্থায় পৌঁছালো?

কিছু কিছু গোরস্থানের ইতিহাস বহু শতাব্দীর পুরাতন। ইরাকের নাজাফ শহরের ওয়াদি আল সালামের কথাই ধরুন না! পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ এ গোরস্থানে দাফন হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ! তবে অধিকাংশ গোরস্থানের আয়ুই ওয়াদি আল সালামের মত বড় নয়। কারণ কয়েকটি সভ্যতা ছাড়া মানুষের ইতিহাসে মৃতদের মাটি খুঁড়ে কবর দেয়ার রেওয়াজই যে চালু হয়েছে অনেক পরে। প্রাচীণ পূর্বপুরুষরা মৃতদেহ সৎকারের জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতেন। মৃতদেহকে নিয়ে কখনো গুহার ভেতরে, কখনো গাছের মগডালে, আবার কখনো বিশাল পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসা হতো! এছাড়া অনেকে মৃতদেহের সঙ্গে ভারী কিছু বেধে দিয়ে কোনো হ্রদের তলায় ডুবিয়ে দিতেন, ভেলায় ভাসিয়ে সাগরে ভাসান দেয়ারও দৃষ্টান্ত ছিলো অহরহ। তবে সবচেয়ে প্রচলিত রেওয়াজটি সম্ভবত পুড়িয়ে ফেলা।

কিছু সমাজের নিয়ম ছিলো আরো ভয়াবহ - তারা মৃতকে রোস্ট করে সবাই মিলে ঐতিহ্যবাহী উৎসব আয়োজন করে খেয়ে ফেলত! এক নাগাড়ে যে এতসব আজব উপায়ের কথা বললাম, এগুলোই ছিলো আদিম মানুষদের মৃতের প্রতি 'শ্রদ্ধা' জ্ঞাপনের বিশেষ পদ্ধতি! তবে তখন বেশ কিছু মানব সমাজে কবর দেয়ার রীতিও যে ছিলো না তা কিন্তু নয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে যে প্রাচীণ কবরের সন্ধান পাওয়া যায় সেটি প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বছরের পুরানো। তবে সেটির উদ্দেশ্য ছিলো ভিন্ন। ধারণা করা হয়, মৃতের কিছু শত্রুভাবাপন্ন লোক তার মৃতদেহের 'সম্মানহানি' করার জন্য, সে যাতে 'উপযুক্ত' সৎকার থেকে বঞ্চিত হয় সেজন্য তাকে ষড়যন্ত্র করে মাটি চাপা

তবে যেভাবেই পৃথিবীর প্রথম কবর দেয়ার ঘটনা ঘটুক না কেন, মানুষ কিন্তু অচিরেই এর কিছু সুফল দেখতে পায়। কবর দেয়ার ফলে মৃতদেহকে আর শেয়াল শকুনে টেনে নেয়ার ভয় থাকলো না। মানুষদেরও দেখতে হলো না তাদের চোখের সামনে থেকে তাদের প্রিয়জনের মৃতদেহ আস্তে আস্তে পচে গলে যাচ্ছে। এসব উপকারের কথা চিন্তা করেই আদিম মানুষরা হয়তো মৃতদেহ সৎকারের তখনকার প্রচলিত উপায় বাদ দিয়ে কবর দেয়ার প্রতি দৃষ্টি দেয়। মৃতদেহ সৎকারে কবর দেয়ার রীতি ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে প্রচলিত হয়ে ওঠে। কবর দেয়ার রীতি চালু হবার পাশাপাশি আরো একটি রীতি চালু হয়ে যায়। কবর যেহেতু একটি মাটির ঘর, তাই সেকালের মানুষরা কবরকে মৃতের ঘর হিসেবে গণ্য করত। সেখানে মৃতের ব্যবহারের জন্য আসবাবপত্র, বাসনকোসন রেখে আসার রেওয়াজ ছিলো। মূলত মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম ধারণা থেকেই এই রীতি চালু হয়।

 

 

সম্প্রদায়ভিত্তিক মৃতদেহ দাফনের একটি এলাকা তৈরির চর্চা সবার আগে শুরু হয় পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায়, প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার বছর আগে। মূলত ওই সময়টাতে এসব অঞ্চলে মানুষ যাযাবর জীবন যাপন ছেড়ে স্থায়ী বসতি স্থাপন শুরু করে। সিথিয়ান নামক যাযাবর জাতি মৃতদেহের জন্য স্থায়ী কবরখানা তৈরির সংস্কৃতিকে আরো প্রজ্জলিত করে। তারা 'কুরগান' নামক স্তূপীকৃত কবর তৈরির জন্য বিখ্যাত। ইট্রুরিয়ার অধিবাসীরা সুবিশাহ বিস্তৃত নেক্রোপলিস বানাতো, সেখানকার কবরগুলোর গম্বুজে তাদের বিশেষ ছক আকৃতির চিহ্ন বসানো থাকতো। প্রাচীন রোমে ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্র বানানো হতো, সেখানো শবদেহ পোড়ানোর পর ছাইভস্ম এবং না পুড়িয়ে শুধু কবর দেয়ার ব্যবস্থাও 

সেমেটারি শব্দটি প্রথম ব্যবহার করে গ্রিকরা। এর অর্থ করলে দাঁড়ায় 'স্লিপিং চেম্বার' বা ঘুমানোর কুঠুরি। গ্রিকরা তাদের শহরগুলোর অদূরে গোরস্থান নির্মাণ করতো। গোরস্থানের কবরগুলোতে স্মৃতিফলক বসানোর কৃতিত্বও তাদের। মধ্যযুগে ইউরোপে এসে গোরস্থানের ধরণ-ধারণ রীতিমত পালটে যায়। খ্রিষ্টানদের গীর্জাগুলোর সামনে সামান্য খোলা স্থানে গোরস্থান বানানো হয়। তবে সেখানে মৃতদের শান্তিতে ঘুমানোর জো ছিলো না। কবরখানাতেই বসত বাজার, মেলা, সভা সমাবেশ কত কিছু। এমনকি সামান্য খোলা জায়গা পেয়ে কৃষকরা গরুও চড়াতে নিয়ে আসতো! তারা বিশ্বাস করত, গোরস্থানের ঘাস খেলে গরুর দুধ মিষ্টি হয়!

তবু শহরে শহরে গোরস্থানের জন্য গির্জার সামনের যে সামান্য জায়গা বরাদ্দ ছিলো, শিল্প বিপ্লবের ফলে সেটুকুও হারাতে হলো। তার বদলে শহরতলী ও গ্রাম্য এলাকায় গড়ে উঠলো বিশালাকার সব গোরস্থান। বিশাল উদ্যানপ্রতীম সেসব গোরস্থান সাজানো হয় সুসজ্জিত সব ভাস্কর্য ও পাথরের মূর্তি এবং গম্বুজ দিয়ে। গোরস্থানের জায়গাগুলো একসময় শুধু ধনীদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও আস্তে আস্তে তা মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণীর জন্যও সহজলভ্য হয়ে ওঠে। শেষকৃত্যানুষ্ঠান তো বটেই, বিবাহবার্ষিকী, ছুটির দিনের আনন্দ আয়োজন এমনকি বিকেলের অবকাশযাপনেরও কেন্দ্র হয়ে ওঠে সুন্দরভাবে সাজানো গোরস্থানগুলো। কিন্তু ১৯ শতকে পার্ক, প্রমোদউদ্যান তৈরির সংস্কৃতি চালু হবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আমোদ প্রমোদের জন্য গোরস্থান ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। গোরস্থান নির্জন হতে থাকে ধীরে ধীরে।

তবে এই গোরস্থান ধারণাটি বোধ হয় আর বেশিদিন টিকছে না। লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, হংকং এর মতো শহরগুলোতে এরই মধ্যে গোরস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার সংকট পড়েছে। তাছাড়া গোরস্থান এমন একটি জায়গা, যার পরিধি বছরের পর বছর বাড়তেই থাকে, মৃত্যুর মিছিল তো থেমে থাকে না! আর প্রতিটি কবর স্থায়ীভাবে জায়গা নিয়ে নেয়। মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ওই জায়গায় মানুষ নতুন কিছু নির্মাণ করতে দ্বিধাবোধ করে। কিন্তু জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, অদূর ভবিষ্যতে গোরস্থান রাখা খুব কঠিন হবে। মানুষ তাই এখন ভাবছে শবদাহের মত বিকল্প সৎকারের কথা।

 

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –