• সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৭ ১৪৩১

  • || ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সেই হাতই এখন কর্মক্ষম

প্রকাশিত: ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩  

 
তৃতীয় লিঙ্গের সুবর্ণা, শশী ও সানি। এক সময় তারা প্রতিদিন রঙিলা সাজে বের হতেন। দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে ঘুরে টাকা (চাঁদা) তুলতেন। কখনো শহরের রাস্তাঘাট, পাড়া-মহল্লায় নয়তো বিয়েবাড়িতে দেখা যেত তাদের। আবার কখনোবা বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশনে। এসব জায়গাতে সপ্তাহের কোনো না কোনো দিন দেখা মিলত সুবর্ণাদের। দলের সঙ্গে থেকে হাততালি দিয়ে অন্যের কাছে টাকা-পয়সা চাওয়া, না পেলে গালাগালি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অপদস্থ করে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করা নয়তো তর্কে জড়ানো ছিল তাদের নিত্যদিনের ঘটনা।

কেউ কেউ সাহায্যের হাত বাড়াতেন। অনেকে গালমন্দ এমনকি মারধরও করতেন। ঠাট্টা, টিটকারি, তিরস্কার এসবে কাটত তাদের একেকটি দিন। কিন্তু এখন সুবর্ণারা আর আগের সেই অবস্থানে নেই। রঙিলা সাজ আর হাততালি দিয়ে তাদের চাইতে হয় না চাঁদা। কুটিরশিল্পের কাজে জড়িয়ে তাদের অনেকেই এখন কর্মক্ষম। নিজের মুখের অন্ন জোগাচ্ছেন। নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের দেখভাল করছেন। অভিমান ভুলে পরিবারে ফিরে কেউ কেউ ধরেছেন সংসারের হাল।

সুবর্ণা, শশী, সীমার মতো প্রশিক্ষণ পাওয়া বাবু, রুবেল, রুমা, অপু, দোলা, সজলও একই স্বপ্ন দেখছেন। তারা চান সবাই নিজেদের উপার্জিত আয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তাদের গুরুমা আনোয়ারা ইসলাম রানী।

রংপুরে তৃতীয় লিঙ্গের প্রায় ৪০০ জন রয়েছেন। তাদের মধ্যে রংপুরের নগরের নূরপুর জেএনসি রোডে (ছড়ারপাড়) একটি পুরোনো, স্যাঁতসেঁতে ও জরাজীর্ণ বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছেন ৪০-৫০ জন। সেখানে তিনটা রুমে গাদাগাদি করে থাকেন তারা। শীতের সময় থাকতে কষ্ট না হলেও গরমকালে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের।

সমাজের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে লক্ষ্যে ২০০৯ সালে ‘ন্যায় অধিকার হিজড়া উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন আনোয়ারা ইসলাম রানী। এই সংগঠনের মাধ্যমে রংপুর নগরীর নজরুল চত্বর এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের হস্ত ও কুটিরশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের অনেকেরই কম্পিউটার, বিউটিপার্লার, দর্জি ও রান্নাবান্নার প্রশিক্ষণ রয়েছে। শুধু মূলধন আর কাজ করার জায়গা ও পরিবেশ না পাওয়ায় পিছিয়ে পড়েছে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠী।

বর্তমানে প্রশিক্ষণ শেষে শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, ফুলদানি, মাটির কার্টেল, কয়েলদানি, কলমদানিতে নকশাসহ বিভিন্ন ধরনের শোপিস তৈরি করা শিখছেন তারা। এসব কাজ করে দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয় তাদের। অন্যদিকে তাদের উৎপাদিত এসব হস্তশিল্প ক্রয় করছে রূপায়ণ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

আগে মানুষের কাছে হাত পাতলেও বদরগঞ্জের কোহিনুর আট মাস ধরে হস্তশিল্পের কাজ করছেন। কোহিনুর বলেন, কাজ করে দুই টাকা রোজগার করে বেঁচে আছি। এসব হয়েছে গুরুমা আনোয়ারার কল্যাণে। তার কারণেই আজ আয়ের বাড়তি টাকা আমার পরিবারকেও দিতে পারছি।

তৃতীয় লিঙ্গের দোলা বলেন, হস্তশিল্পের কাজ করে মা-বাবা, ভাইবোনদের খরচ চালাচ্ছি। এখন নানা অঙ্গভঙ্গি করে মানুষের কাছে আর হাত পাততে হয় না। আমরা শ্রম দিই। এর বিনিময়ে রোজগার করা টাকায় ডাল-ভাত খাই। এ অনেক শান্তির, তা বুঝতে পেরেছি। এখন অনেক ভালো আছি। আর কেউ আমাদের গালমন্দ করেন না। বরং প্রতিবেশী, স্বজন, বন্ধুরা শ্রদ্ধার চোখে দেখে।

রংপুর নগরীর তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নেতৃত্বে থাকা আনোয়ারা ইসলাম রানী থাকেন নুরপুর এলাকায়। আর ১০টা সন্তানের মতো চান মিয়া ও জুলেখা দম্পতির ঘরে তার জন্ম। কিন্তু জন্মের পর ১২ বছর বয়সে আনোয়ারা তার শারীরিক পরিবর্তন বুঝতে পারেন। তাকে নিয়ে সহপাঠী, প্রতিবেশী, বন্ধুরা শুরু করেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য।

২০০৯ সালের ঘটনা আনোয়ারার সঙ্গে মোহন নামে একজন হিজড়ার পরিচয় হয়। তখনই তিনি হিজড়াদের কমিউনিটিতে যোগ দেন। একদিন অন্যান্য হিজড়াদের সঙ্গে চাঁদা তুলতে বের হলে মারধরের শিকার হন আনোয়ারা। তখনই সিদ্ধান্ত নেন যেন আর কারও কাছে হাত পাততে না হয়, সমাজের আর দশজন মানুষের মতো করে যেন জীবিকার পথ হয় সেই ব্যবস্থাই করবেন।

এমন ভাবনা থেকেই ২০১৯ সালে ঢাকার একটি কালচারাল প্রোগ্রামে আনোয়ারার সঙ্গে পরিচয় হয় মানব ফাউন্ডেশন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরিচালক আলামিন গগনের। তার সহযোগিতায় হস্তশিল্পের কাজ শেখেন। এরপর রংপুরের নজরুল চত্বর এলাকায় ভাড়া বাসায় সংগঠনের সদস্যদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগিয়ে দেন। এখন পর্যন্ত শতাধিক হিজড়া প্রশিক্ষণ নিয়ে শাড়ি, থ্রি পিচ, পাঞ্জাবিতে, ফুলদানি, মাটির কার্টেল, কয়েলদানি, কলমদানিতে নকশাসহ বিভিন্ন ধরনে শোপিস তৈরি করে দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করছেন।

আনোয়ারা ইসলাম বলেন, আমরাও মানুষ। মানুষ হয়ে মানুষের কাছে হাত পাতা কতটা যন্ত্রণার- এটা শুধু তারাই বোঝেন, যারা এমন পরিস্থিতিতে পড়েন। আমি হিজড়াদের হাত পেতে চাঁদা তোলার থেকে বের করে আনার ক্ষুদ্র চেষ্টা করছি। শতাধিক হিজড়া এখন হস্তশিল্পের কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে কারুপণ্যে ২০ জন চাকরি করছেন। তারা নিজেদের খরচ বাদেও পরিবারে অর্থের জোগান দিচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সংগঠনটিকে ২০১৭ সালে সমাজসেবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে রংপুর বিভাগের চার শতাধিক তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য রয়েছেন। তারা প্রতি মাসে সংগঠনের তহবিলে ২০০ টাকা করে জমা রাখেন। এ টাকা তাদের ও সমাজের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত প্রশিক্ষণকে কেন তারা জীবন বদলানোর সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে আনোয়ারা ইসলাম বলেন, সমাজসেবার প্রশিক্ষণ আর সামান্য কিছু টাকা দিয়ে জীবন বদলানো সম্ভব নয়। স্বাবলম্বী হতে হলে অনেক কিছুই প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যেমন প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছু করতে চাচ্ছি, তেমনি এই সমাজকেও আমাদের কিছু করার জন্য জায়গা করে দিতে হবে। সমাজ ও সামাজিকতা থেকে বৈষম্য দূর করে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমরা পরিবর্তন হতে তৈরি, সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাবমতে, দেশে প্রকৃত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ১২ হাজার। তবে এই জনগোষ্ঠীর দাবি, দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা দেড় থেকে দুই লাখ। সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে তাদের জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি চালু করে। স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দিচ্ছে। ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে বিশেষ ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ শেষে অনুদানও দেওয়া হচ্ছে।

রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুল মতিন জানান, জেলার তালিকাভুক্ত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মধ্য থেকে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে অনেকে বয়স্কভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন। অনেকে প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন। প্রশিক্ষিতদের অনেকে স্বাবলম্বীও হয়েছেন।

অন্যদিকে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, আনোয়ারাদের কার্যক্রম দেখেছি। তারা নিজেদের বদলাতে চান। হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলছেন। তৃতীয় লিঙ্গের সবার উচিত তাদের অনুসরণ করা।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –