• মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৮ ১৪৩১

  • || ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘এখন আমি মরেও শান্তি পাব’

প্রকাশিত: ৩ আগস্ট ২০২৩  

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম রংপুর সফরে গিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ১১ মে। রংপুরের কালেক্টরেট মাঠে লক্ষাধিক মানুষ সংবর্ধনা দেয় বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন বিশাল জনসভায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখতে ও তার ভাষণ শুনতে রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী জেনিফার আলী এলি তার ক্লাসমেট ইয়াসমিনসহ অনেকের সঙ্গে গিয়েছিলেন কালেক্টরেট মাঠে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও ভিড় ঠেলে তারা বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতে পারেননি।  

কিন্তু হাল ছাড়েননি জেনিফার। জানতেন বঙ্গবন্ধু সার্কিট হাউসে আছেন। তাই পরদিন সকালে স্কুল থেকেই আরও কয়েকজনকে নিয়ে চলে যান সার্কিট হাউসে। গেটে বাধা দেয় পুলিশ। কিন্তু দেয়াল টপকে সার্কিট হাউসের বারান্দায় প্রায় বঙ্গবন্ধুর কক্ষের কাছে চলে যান। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পান । বঙ্গবন্ধু তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন। পরদিনের প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হয় সেই ছবি।

সেই ঘটনার ৫১ বছর পর বুধবার (২ আগস্ট) রংপুরে আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে একই স্থানে অর্থাৎ রংপুর সার্কিট হাউসে ষাটোর্ধ্ব জেনিফারের মাথায় একইভাবে হাত রাখলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঠিক যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। ভাগ্যবান জেনিফার পেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালোবাসা।

জেনিফার আলী এলির শেষ ইচ্ছা ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্পর্শ দেখা। দীর্ঘদিনের সেই ইচ্ছে পূরণ হওয়ায় আনন্দে ভাসছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেনিয়ারকে জড়িয়ে ধরেছেন। খোঁজখবর নিয়েছেন। মাথায় হাত দিয়ে দোয়াও করেছেন।

আনন্দে উদ্বেলিত জেনিফার আলী এলি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্পর্শ পেয়েছিলাম। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও স্পর্শ পেলাম। এটিই আমার তৃপ্তি, পরম সান্ত্বনা। সার্কিট হাউসে আমার মাথায় বঙ্গবন্ধুর হাত রাখা সেই ছবিটির সামনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি।  

তিনি আরও বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছে। আমি খুব খুশি, ওখানকার (সার্কিট হাউসের) সবাই খুব খুশি। এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। যেই সার্কিট হাউসে তার বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলাম, আজ (বুধবার) তার মেয়ের সঙ্গেও দেখা করলাম। এখন আমি মরেও শান্তি পাব। আমার দীর্ঘদিনের আশা পূর্ণ হয়েছে।

জেনিফার আলী এলি বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ পাওয়ার কথা স্মরণ করে বলেন, আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়তাম। ১৯৭২ সালের মে মাস ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু রংপুরে ছিলেন। তখন রংপুর এ রকম সাজানো ছিল না। জনবসতি ছিল কম। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য হাজার হাজার মানুষ হেঁটে গ্রামগঞ্জ থেকে রংপুর শহরে আসেন। সেদিন স্কুল পালিয়ে আমিও দূর থেকে তার  ভাষণ শুনেছি। পরদিন মর্নিং স্কুল ছিল। বঙ্গবন্ধু রংপুর সার্কিট হাউসে ছিলেন। ইচ্ছে ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিজ চোখে দেখার। কয়েকজন বান্ধবীসহ চলে আসি। সার্কিট হাউসে ঢোকার সময় গেটে পুলিশ বাধা দেয়। শেষে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

তিনি আরও  বলেন, একজন এসে জিজ্ঞেস করল, এই তোমরা এখানে কী করছো? আমি বললাম, বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চাই। এ সময় বারান্দা দিয়ে সাজেদা চৌধুরী হেঁটে আসছিলেন। সঙ্গে আরও ২/৩ জন ছিলেন। তিনি আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। আমরা পরিচয় দিয়ে তাকে বললাম বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যাব। সাজেদা চৌধুরী জানালেন, ‘বঙ্গবন্ধু তো খুব ব্যস্ত। লোকজনের ভিড়। সামনের রুমে উনি আছেন। ঢুকে পড়ো। তখন রুমে অনেক লোক। রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম বিছানায় কোলবালিশে হেলান দিয়ে পাইপ হাতে বঙ্গবন্ধু কথা বলছেন। আমরা ঢুকেই এক পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

জেনিফার বলেন, হঠাৎ বঙ্গবন্ধু আমাদের দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কাকে চাও? আমি বললাম, বঙ্গবন্ধুকে দেখতে চাই। বঙ্গবন্ধু তখন মজা করে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু! কে বঙ্গবন্ধু?’ আমি বললাম আপনিই তো বঙ্গবন্ধু। আমি আপনার অটোগ্রাফ নেব। আমার কাছে কোনো কাগজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু আমার ডান হাতটা টান দিয়ে লিখে দিলেন শেখ মুজিব। আমার খুব আফসোস হয়, ‘একটা কাগজ থাকলে আজও সযত্নে রেখে দিতে পারতাম বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফটি। বঙ্গবন্ধুর সেই হাসি, চুরুটের পাইপ, বালিশে হেলান দিয়ে থাকার দৃশ্যগুলো এখনো স্মৃতিতে ভাসে।

তিনি আরও বলেন, পার্টির লোকজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করবে। ওখান থেকে কে যেন বলল, ‘তোমরা বাইরে যাও।’ আমরা চলে আসি। বঙ্গবন্ধু ঢাকা চলে যাবেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সার্কিট হাউসের করিডর দিয়ে হেঁটে বের হচ্ছেন। আমি দৌড়ে ইটের খোপ বেয়ে দেয়ালের ওপরে উঠে গেলাম। স্লোগান দিলাম-‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ ‘আমার নেতা, তোমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’ বঙ্গবন্ধু করিডরে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করে সবাইকে থামালেন। হাতে থাকা ফুলের তোড়া থেকে একটি ফুল আমাকে দিলেন। আমার মাথায় হাত রেখে আদর করে বললেন, ‘তুই ঘেমে গেছিস তো, এইবার থাম। হয়েছে, হয়েছে।’ কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের বললেন, ‘তোরা তো পারলি না, ওর (এলির) সঙ্গে তোরা পারলি না।’  আমি তখন পর্যন্ত জানতাম না আমার ছবিটি তোলা হয়েছে। পরদিন ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ইত্যাদি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু হাত রেখেছেন ছোট মনি এলির মাথায় ক্যাপশনে ছাপা হয়েছিল ছবিটি। ঢাকার ৩২ নম্বর জাদুঘরে ছবিটি আজও ঝোলানো আছে।

জেনিফার আলী এলি আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলেন, স্পর্শ সুখের অনুভূতি আবৃত্তি করে বেঁচে থাকা যায়। স্পর্শ সুখ জীবনের গোপন সম্পদ হয়ে ওঠে কখনো কখনো। সেই স্পর্শ যদি হয় সমৃদ্ধ কোনো ব্যক্তির হাতের তবে তো কোনো কথাই নেই। ওই স্পর্শ সুখের স্মৃতি আওড়িয়ে পেরিয়ে আসা জীবনের দিনগুলো বন্ধ চোখে দেখা যায় যখন তখন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার মাথায় স্পর্শ করে আদরের রেশ রেখে গেছেন। এখনো সেই স্পর্শ রেশ অন্য রকম অনুভূতি এনে দেয় আমাকে। জীবনের প্রায় শেষ আয়ুতে এসেছি। আমার একটিই বাসনা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মুখে সালাম করা। বঙ্গবন্ধু আমার মাথার যে স্থানে স্পর্শ করে আদর করেছেন সেই স্থানে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পর্শ নেওয়া। অবশেষে আজ তা পূর্ণ হলো।

উল্লেখ্য, জেনিফার আলী এলি রংপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফের সহধর্মিণী। তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তার দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। 

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –