• মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৯ ১৪৩১

  • || ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সাড়ে ৩ দশক ধরে লাশ টানছেন আব্দুল মান্নান

প্রকাশিত: ২৫ জুলাই ২০২৩  

 
রিকশা কিংবা ভ্যান মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় বাহন হলেও তার ভ্যানে ওঠেন না সাধারণ মানুষ। তবে কারো অস্বাভাবিক মৃত্যু, আত্মহত্যা, হত্যাকাণ্ড, দুর্ঘটনায় নিহত কিংবা গলিত-অর্ধ গলিত লাশ পাওয়া গেলে ডাক পড়ে তার। শুধু তাই নয়, ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলন, বেওয়ারিশ লাশ দাফনের ক্ষেত্রেও বিকল্প নেই সেই মানুষটির।

সাধারণ মানুষ যখন দর্শকের ভূমিকা পালনে ব্যস্ত ঠিক তখনই লাশের কাছে এগিয়ে যান তিনি। প্রশাসনের নির্দেশে লাশ নিয়ে কখনো মর্গে, আবার কখনো বা নিহতের বাড়িতে ছুটে যান। বলছি দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার মনমথপুর ইউনিয়নের হঠাৎ পাড়া গ্রামের এছার উদ্দীনের ছেলে আব্দুল মান্নানের (৫৩) কথা।

আশির দশকে মর্জিনা বেগমের সঙ্গে বিয়ের পর হোটেল শ্রমিকের কাজ ছেড়ে বেশি বেতনের আশায় কাজের সন্ধানে রাজধানীতে পাড়ি জমান আব্দুল মান্নান। কাজের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থে ভালোই কাটছিল তাদের সাংসারিক জীবন। হঠাৎ মর্জিনা বেগম অসুস্থ হলে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হন আব্দুল মান্নান। চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত শুরু হয়। সংসারের চাকা ঘুরাতে শুরু করেন রিকশা চালানো। হঠাৎ একদিন গভীর রাতে পার্বতীপুর মডেল থানা থেকে ডাক আসে আব্দুল মান্নানের। আত্মহত্যার লাশ নিয়ে যেতে হবে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর হাসপাতাল মর্গে। বিনিময়ে দেওয়া হবে টাকা।

অভাবের কারণেই অসীম সাহসী ও উদ্যমী আব্দুল মান্নান রাজি হয়ে যান। এর মাধ্যমে তার লাশ বহনের কাজের সূচনা হয়। এভাবেই ৩৬ বছর ধরে পার্বতীপুর মডেল ও রেলওয়ে থানার অধীনে লাশ বহনের কাজ করছেন তিনি। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি লাশ বহন করেছেন মান্নান। মাসুদ রানা ও বিদ্যুৎ আলী নামে দুই ছেলে রেখে মারা যান তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম। পরবর্তীতে ফিরোজা খাতুন পপিকে বিয়ে করেন আব্দুল মান্নান। লাশ বহনের এ টাকায় চলে তার সংসার। শুরুর দিকে তার পরিবার ব্যতিক্রমী এ পেশাকে মেনে না নিলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাও অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। 

আব্দুল মান্নান বলেন, শুরুতে লাশ টানার সময় মনের মাঝে একটু ভয় ভীতি লাগলেও এখন কিছুই মনে হয় না। লাশ ভ্যানে তোলার পর সাধারণ যাত্রীর মতোই মনে হয়। ভ্যানটিতে শুধু লাশ বহন ছাড়া সাধারণ যাত্রী উঠতে চান না।

কারণ তিনিও জানেন, এই ভ্যানে সাধারণ যাত্রী উঠবে না। তাই অনেক সময় অলস হয়ে বসে থাকতে হয়। কখন মুঠোফোনের ঐ পাশ থেকে বলবে লাশ নিয়ে যেতে হবে মান্নান ভাই। তাড়াতাড়ি আসেন। এর অপেক্ষায় থাকে মান্নান। কারণ তার ভ্যানের চাকা ঘুরলেই যে ঘুরবে সংসারের চাকা। সময় মতো মর্গে উপস্থিত হতে না পারলে পড়তে হয় বিপাকে। শুধু তাই নয়, অনেক সময় মর্গের সামনে বিশ্রাম ও খাবার সেরে নিতে হয় তাকে।

তিনি আরো বলেন, একটি লাশের ময়নাতদন্ত করা হলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পাই। কখনো কাউকে বিপদে ফেলে টাকা নিই না। অনেকে বকশিশও দেন। এর থেকে আবার কিছু অংশ খরচও হয়। মাঝে মাঝে লাশ বহনে যে আয় হয়, সেটা দিয়ে কোনো রকমে চলে তার সংসার। তবুও লাশ টানার এ পেশা ছাড়েননি তিনি।

তার মতে, এটি একটি মহৎ পেশা। তিনি বলেন, সবাইকে একদিন এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে। তাই মানুষের শেষ যাত্রায় সঙ্গী হতে পেরে আমার খুব ভালো লাগে। অনেক সময় বেওয়ারিশ লাশ হলে আমি তার দাফনের ক্ষেত্রে কোনো টাকা পয়সা নিই না।

পার্বতীপুর মডেল থানার ওসি আবুল হাসনাত খান বলেন, আব্দুল মান্নানের এ পেশাকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। একটি একটি মহৎ কাজ। যেকোনো সময় আমরা তাকে ডাকা মাত্রই পাই। ফলে আমাদেরও কাজের সুবিধা হয়। লাশ বহনে তার কোনো গড়িমসি নাই। এ কাজের জন্য ভুক্তভোগী পরিবার তাকে সাধ্যমতো খুশি করার চেষ্টা করে।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –