• মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ৯ ১৪৩১

  • || ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হরেকরকম পসরা সাজিয়ে শিশুদের আনন্দ দেওয়াই তার নেশা!

প্রকাশিত: ১২ জুলাই ২০২৩  

 
‘আগে জিনিসপত্রের দাম কম ছিল, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো না। এখন তো সবকিছুর দাম বেশি। খেলনা বিক্রি করে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়। এই সামান্য আয়ে বাচ্চাদের পড়ালেখা আর সংসারের খরচাপাতি করতে খুব কষ্ট হয়। তারপরও আমি খুশি, ভালো আছি। ব্যবসা ছোট হোক তবু তো ভিক্ষা করি না।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী হাসান আলী। তিনি রংপুর মহানগরীর হনুমানতলা এলাকায় সরকারি খাস জমিতে গড়ে ওঠা অস্থায়ী বস্তিতে থাকেন। সংসার জীবনে তার স্ত্রী ও তিন মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। মেয়েদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানোর পর বিয়ে দিয়েছেন। আর দুই ছেলের মধ্যে একজন এবার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।

হাসান আলী এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শিশুদের খেলনা বিক্রি করে আসছেন। এর আগে তিনি চানাচুর ও চটপটি বিক্রি করতেন। পুঁজি কম থাকায় ব্যবসার ধরণ পরিবর্তন করে এখন তিনি পুরোপুরি খেলনা বিক্রেতা। সম্প্রতি হাসান আলীর সঙ্গে রংপুর কালেক্টরেট সুরভি উদ্যানের সামনে আলাপচারিতায় এসব তথ্য জানা যায়। 

রোদ, বৃষ্টি ঝড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি সুরভি উদ্যানের প্রবেশ পথেই দেখা মিলবে হাসান আলীর। হরেকরকম খেলনার পরসা সাজিয়ে প্রতিদিনই শিশুদের আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি খেলনা বিক্রি করেন তিনি। তার এক ফু-তে উড়তে থাকা বুদবুদ আকৃষ্ট করে উদ্যানে আসা দর্শনার্থীদের। এতে কেউ খুশি হয়ে তাকে টাকা দিতে চাইলেও নেন না তিনি। সহযোগিতা করতে চাইলে তিনি অর্থের বিনিময়ে খেলনা তুলে দেন।

হাসান আলী বলেন, প্রতিদিন সকাল ৮টায় এসে খেলনার পরসা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যা বেচা-বিক্রি হয়, সেটাই আমার ব্যবসায়িক আয়। এই আয় দিয়ে কোনো মতে টিকে আছি। সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়। তারপরও পরিবারের জন্য হাল ছাড়িনি। কারণ অন্য কোনো মাঝারি ব্যবসা করার মতো পুঁজি আমার নেই। 

তিনি আরও বলেন, আমি কাজ করে খেতে পছন্দ করি। শরীর-স্বাস্থ্য আল্লাহ ভালো রাখছেন। অনেকেই আছে সামান্য অসুখ-বিসুখে, একটা হাতের বা পায়ের সমস্যার কারণে রাস্তাঘাটে ভিক্ষা করেন। আমি মনে করি এটা ঠিক না। মানুষের কাছে হাত পেতে খাওয়ার চাইতে কষ্ট করে কিছু করতে পারাটাও আনন্দের। আমি তো ভিক্ষা করি না, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। যদিও পরিবারে কষ্ট লেগেই আছে।

বেচাবিক্রি ও সংসারজীবন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুচকি হেসে হাসান আলী বলেন, আমার দিনটা কোনো মতে কেটে গেলেই ভালো। আবহাওয়া ভালো থাকলে বা বিশেষ দিনগুলোতে কখনো কখনো ব্যবসা হয়। তখন ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকার পর্যন্ত খেলনা বিক্রি হয়। এতে ৭শ থেকে হাজার পর্যন্ত আয় হয়। কিন্তু এটা খুব কমই হয়। মূলত প্রতিদিন কমবেশি সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো আসে। 

তিনি বলেন, আমার নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। আগে তো জিনিসপত্রের দাম কম ছিল, মাঝেমধ্যে মাছ-মাংস খাওয়া হতো। এখন আর মাছ-মাংস খাওয়ার চিন্তা করি না। চাল কিনলে সেদিন আর পছন্দ মতো তরকারি হয় না। তার মাঝে আবার ছেলেদের পড়াশোনার খরচও দেয়া লাগে। এখন আর আগের মত ভালো খাওয়া হয় না।

হাসান আলী বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে করোনাকালীন ২ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়ার কথা বলে কাগজপত্র জমা নিয়েছিল কিন্তু আর পরে কোন খবর পাইনি। তারপরে টিসিবির কার্ডেও নাম আসে নাই। আমাকে সহযোগিতা না দিক তাতে কষ্ট নেই। প্রশাসনের কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগও নেই। আমাকে উদ্যানের সামনে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছে, এর জন্য জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ। 

ফুঁ দিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়া বুদবুদের দিয়ে তাকিয়ে হাসান আলী বলেন, জীবনে তো অনেক মানুষকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখলাম। অবৈধ পথে চলতে বা আয়রোজগার করতে চাইনা। কষ্ট শুধু মাথা গোঁজার মতো আমার নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। সরকার হাজার হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে থাকার জায়গা করে দিচ্ছে, আমাকেও যদি একটা জমিসহ ঘরের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে জীবনের বাকি দিনগুলো নিজের ঘরে কাটিয়ে শান্তিতে মরতে পারতাম।

রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে হতদরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য টিসিবির কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদি হাসান আলী আবেদন করে থাকে তাহলে তার বিষয়টি দেখা হবে। আর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় রংপুর নগরে কাজ শুরু হলে সেটি আমরা অবশ্যই দেখব।

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –