• বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ১০ ১৪৩১

  • || ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মৃত্যুর খবর শুনলেই ছুটে যান গাইবান্ধার কামরান 

প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৩  

গাইবান্ধা শহরের বাসিন্দা কামরান নাহিদ। বয়স ছত্রিশ ছুঁই ছুঁই। পেশায় উদ্যোক্তা, রয়েছে গরুর খামার। নিজ খামার দেখাশোনার পাশাপাশি সমাজের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করার চেষ্টা করেন। তার স্বেচ্ছাশ্রম ও আন্তরিকতা মন ছুঁয়েছে গ্রামবাসীর।

২০ বছর ধরে মৃত ব্যক্তির গোসল দেওয়ার কাজ করছেন এই যুবক। কারও মৃত্যুর খবর পেলেই নিজ দায়িত্বে ছুটে যান। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া থেকে শুরু করে মরদেহ দাফনের সব প্রস্তুতি তিনি সামাল দেন। শোকাতুর পরিবারকে মুহূর্তের মধ্যেই আপন করে নেন।

ইসলাম ধর্মের রীতি মেনে গোসল দিয়ে দাফনের জন্য প্রস্তুত করেন মরদেহ। এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষকে নিজ হাতে শেষ বিদায়ের গোসল দিয়েছেন তিনি। কখনো গোসল করাতে গিয়ে কেঁদেছেন আবার কোনো মৃত ব্যক্তির মুখে লেগে থাকা হাসি দেখে ফেলেছেন প্রশান্তির নিশ্বাস। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মহতী কাজ করে যেতে যান কামরান।

সম্প্রতি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা হয় কামরান নাহিদের। ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, শৈশব থেকে দেখেছি আশপাশে কেউ মারা গেলে মুরুব্বিরা আমার বাবাকে ডাকতেন। বাবা নিজ হাতে তাদেরকে সুন্দর করে গোসল করাতেন। আমি মনে করি মৃত্যুর পর মরদেহের প্রতি মানবতা দেখানো ইসলাম ধর্মের অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। শেষ বিদায়ের গোসল করানো অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এখানে ভয়ের কিছু নেই।

কামরান আরও বলেন, ২০০২ সালের দিকে আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তখন আমার বাবা শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা মাঝেমধ্যে বলতেন মৃত ব্যক্তির গোসলের কাজে দু-একজন লোক দরকার হয়। অনেক সময় অন্য লোকজনকে ডাকলে আসতে চায় না। বাবা তুমি আমার সঙ্গে থাকলে আমার একটু সাহায্য হবে, মানুষেরও উপকার হবে। এটি সামাজিক ও ধর্মীয় কাজ। অনেক সওয়াব আছে, একইসঙ্গে মানুষের ভালোবাসাও আছে। তখন থেকেই বাবার সঙ্গে মরদেহ গোসলের কাজে যেতাম।

কিশোর বয়সে বাবা গোলাম সরওয়ারের কাছ থেকে মৃত ব্যক্তিকে কীভাবে গোসল দিতে হয় তা শিখেছেন কামরান। বাবার সঙ্গে থেকে অসংখ্য মরদেহের গোসলে সহযোগিতা করেছেন। তার বাবা মারা গেলে গ্রামের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নিজেই বাবার দায়িত্বটি পালন করে আসছেন। করোনা মহামারির সময়েও ভয়ভীতি, মানুষের ঘৃণা ও মৃত্যুঝুঁকি ভুলে গিয়ে কামরান নির্দ্বিধায় মরদেহ গোসল দিয়েছেন। একবারের জন্য পিছপা হননি তিনি।

কামরান বলেন, মূলত ২০০২ সাল থেকেই সামাজিক দায়বদ্ধতা মনে করে পুরোপুরিভাবে এই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। তখন থেকেই বাড়ির আশপাশে কেউ মারা গেলে যেতাম। সেই থেকে দেখতে দেখতে ২০-২১ বছর পার হচ্ছে। মাঝে করোনা মহামারির মধ্যেও মরদেহের গোসল দিয়েছি। তখন এমনও দিন গেছে গোসল দেওয়া, কাফন পরানো এবং দাফনের কাজ পর্যন্ত করতে হয়েছে। মানুষ ভয়ে কাছে আসত না।

তরুণ এই উদ্যোক্তা বলেন, করোনাকালে মরদেহের গোসল করানো ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। গাইবান্ধার সাত উপজেলা ছাড়াও রংপুরের পীরগঞ্জে গিয়েও মরদেহের গোসল করিয়েছি। তখন পরিবারের আপন মানুষরাই ভয়ে দূরে থাকত। সেই সময় গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে শহরের মোমিনপাড়ার এক ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার স্বজনরা মরদেহ বহনের জন্য খাটিয়া আনতে বিভিন্ন মসজিদে গেলেও কেউ তাদের দেয়নি। বাধ্য হয়ে তারা মরদেহটি বাড়ির উঠানে মাটির উপর রেখেছিলেন। আমি নিজেও খাটিয়ার জন্য কয়েক জায়গায় ফোন করেছিলাম, কেউ দিতে রাজি হয়নি। তখন মনে হয়েছিল মৃত্যু বুঝি এমনই। বাধ্য হয়ে মাটির উপরই গোসল দিতে হয়েছিল। পরে সিভিল সার্জন অফিস থেকে একটি মরদেহ বহন করার ব্যাগ নেওয়া হয়েছিল। কোনো লোক ছিল না জানাজার জন্য। অ্যাম্বুলেন্সে করে ওই মরদেহ পৌর গোরস্থানে নিয়ে গিয়ে আমরাই দাফন করেছিলাম।

কামরান নাহিদ বলেন, আমি যে সারা জীবন বাঁচব এমনটি নয়, যেকোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। আমার অনুপস্থিতিতে যেন অন্যরা এই কাজটি করতে পারেন এজন্য তরুণ-যুবক ভাইদের মরদেহ গোসল দেওয়ার কাজটি আমি শেখাতে চাই।

এদিকে, মহতী এই কাজের জন্য সবার কাছে ভালোবাসার মানুষ কামরান নাহিদ। ছোট-বড় সবার মুখে তার প্রশংসা। ভালো কাজের জন্য কামরান সব সময় নিজেকে প্রস্তুত রাখেন, এটা এখন গ্রামের কমবেশি সবাই জানে বলে জানিয়েছেন ডেভিড কোম্পানিপাড়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর ইসলাম ও সুমন মিয়া।তারা জানান, কামরান যে কাজটি করছেন এটি নিঃসন্দেহে অনেক ভালো কাজ। আমরা দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছি তিনি মৃত মানুষদের গোসল দিয়ে আসছেন। এলাকার কেউ মারা গেলে গোসল করানোর জন্য তাকেই ডাকা হয়। ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে তিনি মরদেহের গোসল করান।

জুয়েল মিয়া নামে আরেকজন বলেন, কারও মৃত্যুর খবর পেলেই সেই বাড়িতে ছুটে যান তিনি (কামরান)। আন্তরিকতার সঙ্গে গোসল দিয়ে দাফনের জন্য মরদেহ প্রস্তুত করেন। আমি ছোট থেকেই দেখে আসছি তিনি এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। আগে তার বাবার সঙ্গে তিনি এই কাজ করতেন। পরে বাবার মৃত্যুর পর তিনি নিজেই এই কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। সবাই তাকে অনেক ভালোবাসে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার বায়তুন নুর-জামে মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা আলামিন বলেন, মৃত মানুষের গোসল করানো অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। যে এই কাজ করবে দুনিয়াতে এবং আখিরাত দুই জায়গাতেই তিনি সম্মানের পাত্র হিসেবে বিবেচিত হবেন। শুধু তাই নয় হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, ‘মরদেহের গোসল করানো ব্যক্তির গুনাহ একবার নয়, চল্লিশবার পর্যন্ত আল্লাহ মাফ করে থাকেন।’ এই কাজে ধর্মপ্রাণ যুবকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

খবর: ঢাকা পোস্ট

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –