• শনিবার ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ১৩ ১৪৩১

  • || ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘গরমে মনে হওছে জানটা চলি যাইবে’

প্রকাশিত: ১৫ এপ্রিল ২০২৩  

শুরু হয়েছে বাংলা নতুন বছর। চৈত্রের দাবদাহের মতো বৈশাখেও অতিষ্ঠ জনজীবন। এখন বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টির ছন্দে স্বস্তিতে ফেরার প্রার্থনা সবার। কারণ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে প্রকৃতি পুড়ছে গ্রীষ্মের তাপদাহে। মৃদু তাপপ্রবাহে হাঁপিয়ে উঠেছে খেটে খাওয়া মানুষ।

দেশের অন্যান্য জায়গার মতো উত্তরের বিভাগীয় জেলা রংপুরও পুড়ছে তাপপ্রবাহে। অসহনীয় গরম আর তাপদাহে বিমর্ষ প্রাণ-প্রকৃতি। প্রায় ১০ দিন ধরে এ অবস্থা বিরাজ করছে। স্মরণকালের এমন গরমে মানুষসহ হাঁসফাঁস করছে পশু-পাখিও। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না অনেকেই।  

একদিকে খরতাপে হাঁসফাঁস, আরেকদিকে ঘন ঘন লোডশেডিং। রমজান মাসে এমন অসহ্য দাবদাহে অস্বস্তি সবার মনে। আবহাওয়া অফিস বলছে, এই পরিস্থিতি থাকবে আরও কয়েকদিন। যদিও রোববার থেকে কোথাও কোথাও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। 

আর বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, লোডশেডিং নয় বরং বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পের চলমান লাইন নির্মাণ/পুনর্বাসন কাজ এবং গাছের শাখা-প্রশাখা কর্তনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকছে।

শনিবার (১৫ এপ্রিল) দুপুরে রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিনও একই তাপমাত্রা ছিল, যা এই মৌসুমে রংপুর জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। গেল সাত দিন ধরে রংপুরে তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৬ এর মধ্যে উঠানামা করছে।    

এদিকে সকালে মিঠাপুকুর উপজেলার রানীপুকুরে একটি সবজি ক্ষেতে এক চাষিকে প্রখর রোদ উপেক্ষা করে পরিচর্যার কাজ করতে দেখা যায়। হামিদুল ইসলাম নামে ওই চাষি জানান, গতবারের তুলনায় এ বছর এপ্রিলে বেশি তাপপ্রবাহ অনুভব হচ্ছে। হাঁসফাঁস অবস্থা সবার। তবুও জীবিকার তাগিদে তীব্র রোদে কাজ করতে খেতে নামতে হচ্ছে।

মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ি বাজারের কাছে কথা হয় ভ্যানচালক জহুর আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, ব্যাটারিচালিত চার্জার ভ্যান চালাতে কষ্ট নেই। কষ্ট এই রোদে যাত্রী পরিবহন করতে। বেশি তাপের কারণে মানুষ বের হয় না, এজন্য আয় রোজগার কমে গেছে। নাভিশ্বাস উঠেছে খেটে খাওয়া মানুষের। চলার পথে একটুখানি ছায়া পেলে জিরিয়ে নিচ্ছেন কেউ কেউ।

আরেকদিকে ঈদের কেনাকাটায় বের হওয়া মানুষও নাকাল হচ্ছে গরমে। নগরবাসী বলছেন, প্রচণ্ড গরমে অস্থির তারা। বৃষ্টির প্রতীক্ষায় দিন কাটছে তাদের।

অসহনীয় গরম আর তাপপ্রবাহের মাত্রা বাড়তে থাকার সঙ্গে ঈদের কেনাকাটা করতে রংপুর নগরীর সড়কগুলোতে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে বড় বড় শপিংমল, বিপণীবিতান ও মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। অসহ্য ভ্যাপসা গরমে কষ্ট হলেও ব্যস্ত ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন পরিবহনের চালক, শ্রমিক, দিনমজুরসহ কর্মজীবী মানুষেরা গরম উপেক্ষা করে বের হলেও অনেকেই হাঁসফাঁস করছেন।

নগরীর ছালেক মার্কেটে আসা পীরগাছার ব্যবসায়ী নুরুল আমিন বলেন, পুরো শহরে যানজট। রোদের মধ্যে কষ্ট করে মার্কেটে এসেছি। কিন্তু গরমে শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। এমন ভ্যাপসা গরম না কমলে ঈদে ব্যবসা করা সম্ভব হবে না।

নগরীর স্টেশন রোডে কথা হয় রিকশাচালক সাইফুল মিয়ার সঙ্গে। মাথার ওপর ছাতা থাকার পরও গরমের চোটে হাঁপিয়ে ওঠা এই রিকশাচালক বলেন, ‘গরমে বাড়ির বাইরোত ব্যারে মনে হওছে জানটা চলি যাইবে। এতো ক্যানে গরম বাহে? ঘরোত থাকাও দায়। ফ্যানের বাতাসও গরম। শরীর থাকি খালি ঘাম ঝরোছে। রোইদোত বাইরোত গাড়ি নিয়্যা ব্যারেয়া মোর অবস্থা খারাপ। কিন্তু হামার মতো রিকশা এ্যালার কোনো উপায় নাই। গাড়ি না চালাইলে খামো কী?’

কলেজ শিক্ষার্থী রওনক জাহান বলেন, এবার যে পরিমাণ গরম পড়েছে তা আগের যে কোনো বছরের এপ্রিলকে ছাড়িয়ে গেছে। আমরা বৃষ্টির প্রতীক্ষায় আছি।

নগরীর গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ে সোহেল ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে আসা মাসুমা আক্তার বলেন, দুই দিন থেকে বাড়িতে বাচ্চাসহ চারজন অসুস্থ। প্রচণ্ড রোদ-গরমে জ্বর ও ব্যথায় সবাই কাবু। প্রাথমিক চিকিৎসা করেও জ্বর-সর্দি কমছে না। এ কারণে ওষুধ নিতে বাধ্য হলাম।

এদিকে ঋতু পরিবর্তনের কারণে রংপুরে বেড়ে চলছে হিট স্ট্রোক, জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা তাপপ্রবাহে প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে নিম্নআয়ের মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। সংসার চালাতে বাধ্য হয়েই কাজে যাচ্ছেন তারা। অনেকেই আবার গরম সইতে না পেরে অসুস্থও হয়ে পড়ছেন।

রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা ৩৪-৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়াই ভালো। বিশেষ করে এই সময়ে শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের আরও সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশি বেশি করে তরল জাতীয় শরবত, ডাবের পানি পান করা উচিত।

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রচণ্ড গরমের কারণে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীসহ জ্বর, সর্দি ও ডায়রিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত সাত দিনে অন্তত ৩০-৪০ জন রোগী হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গরমে অনেকেই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই এই সময় সাবধানে চলাফেরা উচিত। বেশি বেশি করে ডাবসহ তরল জাতীয় ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, শনিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন শুক্রবার রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে রংপুর অঞ্চলে অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজ করছে। মৃদু তাপপ্রবাহ ও গরম বাতাসে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি বলেন, সূর্যকিরণ লম্বালম্বিভাবে আসায় গরম তীব্র অনুভব হচ্ছে। বিশেষ করে গরম বাতাস স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি আরও ২/৩ দিন অব্যাহত থাকতে পারে। তবে রোববার থেকে কোথাও কোথাও ঝড়-বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –