• মঙ্গলবার ০১ অক্টোবর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ১৫ ১৪৩১

  • || ২৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরম মমতায় সেবা দেয়া হয় মারুফের `ভালোবাসার` আশ্রমে

প্রকাশিত: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩  

 
পথে পথে ঘুরে জীবন কাটে অনেকের। তাঁদের পরিচয় নেই। ঠিকানা নেই। অযত্ন-অবহেলাই যেন তাঁদের জীবনের নিয়তি। রাস্তার এসব মানুষকেই উদ্ধার করে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলা হয়। নতুন জীবন দেওয়া হয় পরম মমতায়।
ছিন্নমূল মানুষকে নতুন জীবন দেওয়ার এই দরদি লোকটি হলেন মারুফ কেইন। তিনি এ কাজের জন্য নিজের কেনা জমিতে গড়ে তুলেছেন একটি আশ্রম। নাম দিয়েছেন গ্লোরি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা।

মারুফ কাজ করতেন পার্বতীপুর ল্যাম্ব হাসপাতালে। ২০১৪ সালের কোনো একদিন পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশন স্টেশনে এক কাজে যান তিনি। প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করার সময় খেয়াল করলেন অসুস্থ এক বৃদ্ধা কাতরাচ্ছেন। গোঙানির শব্দ। শরীরে ক্ষত। থিকথিক করছে জীবাণু। দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে কিছুটা দূর দিয়েই নাকে কাপড় চেপে চলে যাচ্ছে লোকজন। শুধু চলে যেতে পারলেন না মারুফ। ধীরে ধীরে বৃদ্ধার কাছে গেলেন। তাঁকে উদ্ধার করে একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। পরম মমতায় সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুললেন তাঁকে।

এখান থেকেই অসহায় মানুষের প্রতি মারুফের গল্পের শুরু। প্রথম দিকে এমন কাজের বিরোধিতা করতেন তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম। শত চেষ্টা করেও স্বামীকে না ফেরাতে পেরে এক সময় তিনিও হাঁটলেন স্বামীর পথে। এখন স্বামীর সঙ্গে তিনিও আশ্রমে সেবা দেন। মরিয়ম বললেন, 'স্বামীকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিলাম। এখন মনে হয়, আমার সে সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।'
এরপর থেকে ঠিকানাহীন অসুস্থ মানুষ দেখলেই উদ্ধার করে আশ্রমে নিয়ে আসেন মারুফ। চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এই কাজ করতে গিয়ে প্রথম দিকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। প্রতিবন্ধী ও ক্ষতের দুর্গন্ধযুক্ত মানুষের জন্য বাসা ভাড়া দেওয়া হচ্ছিল না তাঁকে। তবে দমে যাননি মারুফ, মানুষের প্রতি ভালোবাসার টানে বিকল্প পথ খুঁজতে থাকেন। এক সময় চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি আশ্রমের কাজে জড়িয়ে যান। তাঁর কেনা এক টুকরো জমি ছিল রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের হাসিনা নগরে। সেখানেই খুললেন ঠিকানাহীন মানুষের আশ্রম। বর্তমানে ১৮ জন নারী-পুরুষ রয়েছেন এখানে।

রোটারি ক্লাব অব রংপুর পায়রাবন্দের প্রেসিডেন্ট নাফিসা সুলতানা বলেন, 'ওই আশ্রমে কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয় আমার। সংগঠনের উদ্যোগে কিছু সহায়তাও করা হয়। না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, বর্তমান সময়েও অসহায় মানুষের জন্য এত ভালো কাজ হচ্ছে। মারুফ কেইনকে আরও উদ্বুদ্ধ করতে সবার সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার।'

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বদরগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বী সুইটের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, মানবসেবার লক্ষ্যে গড়ে তোলা আশ্রমের কার্যক্রম শুরু হয় টিনশেড ঘরে। পরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন অনেকে। এক মুষ্টি থেকে এক কেজি চাল, একটি গ্লাস, একটি প্লেট, একটি মশারি, কিছু পুরোনো কাপড়- এভাবেই একেকজনের ছোট ছোট সাহায্য অসহায় মানুষের সেবায় যোগ হতে থাকে প্রতিদিন। এখন পাকা চারটি কক্ষে আশ্রমের বাসিন্দাদের সেবা দেন মারুফ ও তার স্ত্রী মরিয়ম। রয়েছেন লক্ষ্মী রানী নামের একজন সেবিকাও।

আশ্রমে গিয়ে দেখা যায়, নাম-ঠিকানা না জানা ১৮ বাসিন্দার মধ্যে নারী ১৪ জন। স্বাভাবিক নন কেউ। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন কেউ, কেউবা হাসছেন খিলখিল করে। কানে না শোনা, চলতে না পারা, চোখে না দেখা মানুষের সংখ্যাই বেশি। কারও পায়ে দগদগে ঘা, সেখান থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। মারুফ নিজেই সেগুলোর পরিচর্যাসহ ওষুধপত্র লাগিয়ে দিচ্ছেন। এই আশ্রমে রয়েছেন সুভাষ রায় নামের এক যুবক। তাঁর বাড়ি ভারতের উত্তরপ্রদেশে। 

জানা যায়, অসুস্থ অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় পড়েছিলেন সুভাষ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই খবর প্রকাশ হলে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁকে এই আশ্রমের জিম্মায় দেন আদালত। ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে তাঁকে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
আশ্রমে এখন পর্যন্ত ৬৮ জনকে বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করে আনা হয়। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ১৯ জনের, স্বজনদের খুঁজে পাওয়ায় বাড়ি ফিরেছেন ৩১ জন।

আশ্রমের নির্বাহী পরিচালক মারুফ কেইন বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও কিছু অসহায় মানুষ ফুটপাতে পড়ে থেকে মৃত্যুর প্রহর গোনে। তাদের সেবা দিতে পেরে নিজের ভালো লাগে। তাঁর দাবি, এই আশ্রম সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় চলে। আশ্রম পরিচালনায় ৩১ সদস্যের একটি কমিটিও রয়েছে। সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশ্রমে আবাসন সংকট রয়েছে।

অসহায় মানুষদের জন্য মারুফ কেইন যা করছেন, তা প্রকৃত ভালোবাসা ছাড়া সম্ভব নয়। এ রকম ভালো কাজে আগামী দিনেও সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বদরগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা গোলাম ফারুকের সঙ্গে। তিনি জানান, অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এর পর রাস্তার ধারে কিংবা রেলস্টেশন হয় তাঁদের ঠিকানা। এসব মানুষের সেবায় হাত বাড়িয়ে দেন মারুফ কেইন।

রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, 'আমি নতুন এসেছি। খুব শিগগির খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।'

– দৈনিক পঞ্চগড় নিউজ ডেস্ক –